পিতৃপ্রতিম শ্রদ্ধেয় শ্রী সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় স্মরণে


গত ১৮ই মার্চ বসন্তপূর্ণিমার সন্ধ্যায় নিদারুণ দুঃসংবাদটি জানালেন তীর্থদা (তীর্থঙ্কর রায়)। অনন্তলোকে যাত্রা করেছেন আমাদের পরমশ্রদ্ধেয় অধ্যাপক রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ শ্রী সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়; শান্তিনিকেতন আশ্রমে সবার বড় কাছের মানুষ সোমেনদা।
আমার এই ক্ষুদ্র লেখা সোমেনদার স্মৃতিচারণ; যেমনভাবে দেখেছি সেই অসাধারন মানুষটিকে। তাঁর কথা বলতে গেলে প্রথমেই মনের পটে ভেসে ওঠে এক সৌমকান্তি স্নেহার্দ্র শিক্ষক। শ্বেতশুভ্র ধুতি-পাঞ্জাবী পরিহিত এক সুপন্ডিত, সুবক্তা, সৌন্দর্যতত্ত্ববিদ, শিল্পী, এক অসম্ভব ইতিবাচক মনের একজন মানুষ, যাঁর সামনে এলে শ্রদ্ধায় মাথা আপনা হতেই নত হয়। বার বার সেই অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার।
সোমেনদার সঙ্গে প্রথম পরিচয় দিয়ে শুরু করি। তাঁকে আমি প্রথম দেখি পাঠভবনে আমার ছাত্রী অবস্থায়। তিনি তখন বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। বিভাগে আসা-যাওয়া করতেন মাধবীবিতানের মধ্যে দিয়ে, কখনো বা গৌরপ্রাঙ্গণ মঞ্চের সামনে দিয়ে। এই সময় শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবেও তাঁকে দেখেছি। তাঁর পান্ডিত্যপূর্ণ বক্তৃতার সবকিছু হয়তো সেই বয়সে বুঝতাম না, তবু তাঁর সুললিত বক্তব্য আকর্ষণ করতো আমাকে।মনে সাধ হ’ত এই অসামান্য মানুষটির সান্নিধ্য পাওয়ার, তাঁর কাছে আসার।
বেশ কিছু বছর পরে সঙ্গীতভবন থেকে নিপ্পনভবনে একটি অনুষ্ঠান করতে গিয়ে সেই সাধ পূর্ণ হয়। সোমেনদার সঙ্গে প্রতক্ষ সম্পর্কের সূচনা হয়। সেদিনের অনুষ্ঠান শেষে বাবার সঙ্গে যখন বাড়ি ফিরছি, ওঁর সঙ্গে দেখা। বাবা তাঁর পূর্ব পরিচিত, তাই কুশল বিনিময় হল। সোমেনদা বাবাকে বললেন, “ভাই রণজিৎ তোমার কন্যেকে নিয়ে একদিন আমার বাড়ি এসো, কেমন।” আমি তাঁকে প্রণাম করাতে আশীর্বাদ করে বললেন, ”মা বাবাকে নিয়ে একদিন আমার কাছে চলে এসো। তোমাকে তোমাদের দেশের বাড়ির গল্প শোনাবো।”
বাবার কাছে জানলাম আমার ঠাকুরদা শ্রী শিবদাস রায় আর সোমেনদার পিতৃদেব শ্রী সত্যেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় দুই অভিন্ন হৃদয় বন্ধু ছিলেন। তাই সোমেনদা আমাদের পরিবারের অনেক পুরোনো গল্প জানতেন। সেই দিনটির পর থেকে এই পিতৃপ্রতিম মানুষটির অগাধ স্নেহাশীর্বাদে বার বার ধন্য হয়েছি আমি।
এই স্মৃতিচারণ লিখতে বসে এত বছরের অনেক কথাই মনের মধ্যে ভিড় করে আসছে। তার থেকেই কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করি। মানুষ সোমেনদার কিছু পরিচয় পাওয়া যাবে এই ঘটনাগুলির মধ্য দিয়ে।
সঙ্গীতভবনে মণিপুরী নৃত্য নিয়ে স্নাতকোত্তর পর্ব শেষ করে রবীন্দ্রনৃত্য নিয়ে গবেষনার কাজ শুরু করি। এই সময়ে আমার কাজের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ এবং রবীন্দ্রনৃত্যচিন্তা সম্পর্কিত নানান বিষয় বোঝার জন্য সোমেনদার শরণাপন্ন হতাম। তিনি সার্থক শিক্ষক। কখনো বিরক্ত না হয়ে অসীম ধৈর্য সহকারে বিষয়গুলি সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতেন আমায়। পরিতৃপ্ত মনে সবসময় মনে হতো সে আমার পরম প্রাপ্তি। ওঁর লেখা বিষয়বস্তুর উপর ওঁরই উপস্থিতিতে নৃত্যানুষ্ঠান করার সুযোগও ঘটেছে আমার।
আমার গবেষণার মৌখিক পরীক্ষার দুজন পরীক্ষকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সোমেনদা। সেদিনের কথা লিখতে ইচ্ছে করছে।পরীক্ষার ঘরে ঢুকে সবাই কে প্রণাম করে বসলাম। তখন শীতকাল, আমি কিন্তু ভয়ে ঘামতে শুরু করেছি। সোমেনদা আমার মুখের ভাব বুঝতে পেরে বললেন, “ভয় পেও না। তোমার সঙ্গে নাচ নিয়ে একটু গল্প করব বলে আমাদের ডাকা হয়েছে”। ওইটুকু কথায় এমন এক স্নেহের আভাস ছিল যে ভরসা পেলাম। পরীক্ষা শেষে হাসি মুখে আমাকে বললেন, “একটা স্টেথো কিনে নিয়ে বাড়ি গিয়ে বাবাকে বল আমি নাচের ডাক্তার হয়েছি।”
আমার বিবাহের সময় আমার স্বামী অভি ও শ্বশুড়মশাইকে দেখে বললেন, “আরে এদের তো আমি অনেকদিন থেকে চিনি। এই বালক তো লন্ডন থেকে এখানে মোহরদির বাড়িতে আসতো। তখন তো মোহরদির সঙ্গে বাবার হাত ধরে আমাদের বাড়িতেও এসেছে। আর মনে আছে বালকটি শোনপাপড়ি খেতে ভালোবাসতো” সোমেনদা অভিকে “বালক” বলেই ডাকতেন।

বিয়ের পরে ব্রাসলস্ পারি দেবার আগে আমরা সোমেনদা ও তাঁর স্ত্রী শ্রদ্ধেয়া নমিতা বৌদির সঙ্গে দেখা করতে গেলাম।আশীর্বাদ করে বললেন, “বালক কে নিয়ে আমাদের সঙ্গে একসাথে খেও কেমন”। বৌদির হাতের তৈরী সুস্বাদু খাবার খাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে বেশ কয়েকবার। আমার তো মনে হয় শান্তিনিকেতনে আশ্রমিকদের মধ্যে খুব কম মানুষই আছেন যাঁরা বৌদির হাতের তৈরী মাছের চপ আর কেক্ খাননি। যাই হোক, সোমেনদার কথা মত বালককে নিয়ে হাজির হলাম বৌদির হাতের রান্না খেতে। কথাবার্তা চলতে লাগলো।এক সময় সোমেনদা বৌদিকে বললেন, “বালকের পরনের জামাটি তো ভারি সুন্দর। তুমিকি তা লক্ষ্য করেছো? বৌদি স্মিত হেসে বললেন, “হ্যাঁ, দেখেছি তো। আমি তো ভাবছিলাম জিজ্ঞেস করব যে কোথা থেকে সংগ্রহ করলে?” আমি তাঁদের জানালাম আমার মা তাঁর জামাইয়ের জন্য এই জামা তৈরী করেছেন হরিতকী ও খয়ের দিয়ে। বাড়ি ফেরার সময় গেটের সামনে রিক্সায় তুলে দিয়ে সোমেনদা বললেন, “মাকে বোলো যে জামা ও জামাই দুই-ই খুব সুন্দর হয়েছে।”
ইউরোপে যে সব জায়গায় গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন, তারমধ্যে কয়েকটি জায়গায় আমাদের যাওয়ার সুযোগ ঘটেছে। সেই সব জায়গা থেকে সোমেনদার সঙ্গে কথা হত। তিনি অধীর আগ্রহে জানতে চাইতেন আমরা কি কি দেখলাম। আর কি কি আমাদের দেখা উচিত। একবার যেমন হাঙ্গেরীর বালাটন্ লেকের ধারে বালাটন্ ফুরেড থেকে কথা হচ্ছিলো। সোমেনদা জানালেন বালাটন্ ফুরেডে শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ করা রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ মূর্তি আছে। রবীন্দ্রনাথ লেকের ধারে যেখানে বৃক্ষরোপণ করেছিলেন, সেই গাছ নিশ্চয়ই ডালপালা মেলে বড়ো হয়ে উঠেছে। তার ঠিক নীচেই মূর্তিটি থাকার কথা। সেখানে পৌঁছে দেখি জায়গাটিতে রবীন্দ্রনাথের একটি আবক্ষ মূর্তি আছে, কিন্তু সেটি রামকিঙ্করের নির্মিত মূর্তি নয়। একটু হতাশ হলাম। দুদিন পরে এক হাঙ্গেরীয়ান বন্ধুর সাহায্যে বালাটন্ ফুরেডের হৃদরোগ হাসপাতালে গিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করলাম, এবং জানতে চাইলাম মূর্তিটির কথা। তাদের কাছে বিশেষ অনুমতি নিয়ে এক হাসপাতাল সেবিকার সাহায্যে পৌঁছলাম হাসপাতালের ২২০ নম্বর ঘরটিতে। সেইখানেই সুরক্ষিত আছে রামকিঙ্কর বেইজের অসামান্য কীর্তি। ফোনে সে কথা জানালাম সোমেনদাকে। বালাটন্ ফুরেডে ঐ হৃদরোগ হাসপাতালের ২২০ নম্বর ঘরটিতে রবীন্দ্রনাথ চিকিৎসাধীন ছিলেন। এই ঘরে বসেই লেখেন তাঁর ‘লেখন’ কবিতাটি।
যতদিন বৌদি জীবিত ছিলেন ততোদিন শান্তিনিকেতনেই ওঁদের সঙ্গে ‘সত্যশ্রী’ বাড়িতেই দেখা করেছি। ফোনেও মাঝে মধ্যেই কথা হ’ত। বৌদি অনন্তলোকে চ’লে যাওয়ার পরে সোমেনদা বেশীর ভাগ সময়ই কোলকাতায় থাকতেন ওঁর পুত্র শোভনদা ও কন্যা জোয়িতাদি দের দুই পরিবারের সঙ্গে। তখন দেশে এসে ওনার সঙ্গে দেখা না করে চলে গেলে কেমন যেন শিশুর মত অভিমান করতেন। প্রতিবার তাই চেষ্টা করতাম অন্তত কিছুটা সময় কলকাতায় সোমেনদার সঙ্গে কাটানোর। সে সব মূহুর্ত আমার কাছে মূল্যবান। একবার আলোদি (রায়) ও আমরা একসঙ্গে গিয়েছিলাম শোভনদাদের কোলকাতার বাড়িতে সোমেনদার সঙ্গে দেখা করতে। ওঁর পুত্রবধূ পৃথা বৌদির হাতের রান্না খেয়ে রাত ১টা অবধি গল্প করে বাড়ি ফিরেছিলাম।
মনে পড়ে, গবেষণার কাজ শেষ হবার পর সোমেনদা বলেছিলেন, “কাবেরী, তুমি অত্যন্ত ভালো একটা কাজ করেছো। আমার আদেশ তুমি এটি বই আকারে প্রকাশ কর”। তাঁর আদেশ শীরোধার্য করেছিলাম। আমার বই লেখার পরামর্শ পেয়েছি ওনার কাছে। শোভনদা বা পৃথা বৌদির সাহায্যে হোয়াটসআ্যপ বা ই-মেল ক’রে আমাকে নির্দেশ পাঠাতেন সোমেনদা। বইটির একটি ভূমিকাও লিখে দিয়েছিলেন বেশ কয়েক বছর আগেই। আমারই দূর্ভাগ্য যে অতিমারির কারণে এই বই প্রকাশের কাজটি সময়মত করে ওঠা গেলো না। এরই মধ্যে বাংলায় শ্যামা নৃত্যনাট্য, রবীন্দ্রনৃত্য ও ইংরেজীতে রবীন্দ্র চিত্রকলা বিষয়ে সাক্ষাৎকার সংগ্রহ করেছি আমরা।
অতিমারির সময়ে অনলাইন মাধ্যমে শান্তিনিকেতনের প্রথাগত সাহিত্যসভা শুরু করার কথা ভাবি। স্থির করলাম সোমেনদকে নিয়েই অনলাইন সভাটি শুরু করব। ফোন মাধ্যমে আবার তাঁর শরণাপন্ন হলাম। এক কথাতেই তিনি রাজি। আমাদের সৌভাগ্য যে দুবার আমরা তাঁকে সভাপতি রূপে পেয়েছি সাহিত্যসভায় । এইসময় পৃথাবৌদির কাছে এক মজার গল্প শুনেছি। অনলাইন সাহিত্যসভা কিভাবে Zoom এর সাহয্যে হবে, কিভাবে বিভিন্ন প্রাক্তনীরা বিভিন্ন দেশ থেকে যোগ দেবেন সেই নিয়ে জোরদার আলোচনা চলছিলো। সোমেনদা সবটুকু মন দিয়ে শুনছিলেন। তারপর খানিকক্ষণ চুপ ক’রে থেকে বললেন, “ তার চাইতে আমরা সদলবলে ব্রাসলস্ গিয়ে অনুষ্ঠানটা ক’রে আসি চল।” আমাদের সবরকম কাজে ছিল তাঁর অসীম আগ্রহ ও উৎসাহদান।

যতবার তাঁর কাছে গেছি, অদ্ভুত এক প্রশান্তি নিয়ে ফিরতাম।অশান্ত মন নিয়ে মন্দিরে গিয়ে পূজা শেষে যেমন ফিরে আসা যায় শান্তির কলসটি হাতে, সোমেনদার সঙ্গে দেখা করে ঠিক তেমনটি হতো।
মঙ্গলময়ের কাছে প্রার্থনা করি শোভনদা,পৃথাবৌদি, সায়ন এবং তাঁদের পরিবারের সকলে যেন সোমেনদার মৃত্যুর এই গভীর শোক কাটিয়ে উঠতে পারেন।
সেই পিতৃপ্রতিম, স্নেহপ্রবণ মানুষটিকে আর কখনো দেখতে পাবো না, সেকথা ভেবে দুচোখ জলে ভরে ওঠে। কিন্তু গুরুদেবের কথায় তো জানি, “ফুরায় যা তা ফুরায় শুধু চোখে/অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার যায় চলে আলোকে।”
সোমেনদা চিরদিন অমর হয়ে থাকবেন তাঁর সৃষ্টির মধ্যে, থাকবেন অগণিত ছাত্রছাত্রী ও গুণমুগ্ধ শ্রোতাদের মধ্যে।
ওঁর কথা দিয়েই শেষ করি এই লেখা, “তাঁর মৃত্যু নেই, এ কথাই বলার ভার নিল তাঁর মৃত্যু।”
